অমিতাভ আইচ

(এই লেখাটি লেখকের গাংচিল পত্রিকার জল সংখ্যায় প্রকাশিত একটি মুল লেখার পরিমার্জিত রূপ)
পৃথিবীর মানবসম্পদের ১৫ ভাগ ভারতে থাকেন আর এই দেশের জলসম্পদের (মিষ্টি জল যা খাওয়ার বা পানের যোগ্য ও কৃষিকাজে লাগে) পরিমান পৃথিবীর মোট জলসম্পদের মাত্র চার (৪) ভাগ। এই জলের মুল উৎস হলো হিমালয় থেকে সৃষ্ট নদীগুলি যা সমস্ত উত্তর ভারতকে বাঁচিয়ে রেখেছে, দক্ষিনের নদীগুলি মুলত বৃষ্টি পুষ্ট। প্রায় সারে চার হাজার বাঁধ স্বাধীনতার পর থেকে তৈরী করা হয়েছে বিগত ৭০ বছরে শুধু মাত্র চাষের ক্ষেতে জল দিতে ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে। কিন্তু তাও দেশের ৬৫ শতাংশ জমি আজও ইরিগেশন বা নদী সেঁচের আওতার বাইরে। এই ছোট ও মাঝারি বাঁধগুলি ভারতের মাথা পিছু বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা বা সংরক্ষিত জলের পরিমান ২০০ কিউবিক মিটারে (এক কিউবিক মিটার মানে ১০০০ লিটার জল) নিয়ে গেছে, যদিও তা চিন, রাশিয়া বা আমেরিকার তুলনায় বহুমাত্রায় কম)। প্রধান নদী গুলি তে বাঁধ দেওয়া জায়গা আর প্রায় নেই, বাঁধের অভিঘাতে অধিকাংশ নদীর জল ধারন ক্ষমতা তীব্র ভাবে কমে গেছে, দূষন বেরে গেছে বহু গুণ। পরিনাম একটাই ভূগর্ভস্থ জলের, কৃষিতে বিপুল ব্যবহার। তথ্য বলছে ভারতের ভূগর্ভস্থ জলের নব্বই ভাগ কৃষিতে ব্যবহার হয় আর সেটা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ এবং এতটাই বেশী যে তা চিন ও আমেরিকার মোট উত্তোলনের থেকেও বেশী। আর এসবের মুল কারন জল খেকো অধীক ফলদায়ী ধান, গম, আখ, তুলার মতো ফসলের চাষ। হিসেব বলছে এক কিলো তুলো তৈরী করতে ২০০০০ থেকে ২৫০০০ লিটার জল লাগে, আখে লাগে ৩০০০ লিটার, ধানে ২৫০০ থেকে ৫০০০ হাজার, গমে ৯০০-১০০০ লিটার।
ভ্রান্তনীতি ও মুনাফার লোভঃপরিবেশ গবেষকরা বহুদিন ধরেই ভারতের জলের আকালের জন্য দেশের ভ্রান্ত কৃষি নীতিকে দায়ী করেছেন। আমরা যদি তাকিয়ে দেখি যে তুলা ও আখ চাষের যে বর্তমান ভরকেন্দ্র মহারাষ্ট্র, গুজরাট তা ভারতের সবচেয়ে শুষ্ক অঞ্চলের মধ্যে পরে। অথচ সবুজ বিপ্লব পরবর্তী সরকারি নীতি, এই ভয়ানক শুষ্ক অঞ্চলের প্রধানতম ফসল, যা শুষ্ক ও খরা প্রবল অঞ্চলে মানুষকে এতো বছর বাঁচিয়ে রেখেছিলো সেই জোয়ার, বাজরা, রাগির চাষ বন্ধ করে হেক্টরের পর হেক্টর আখ ও তুলো চাষ করিয়েছে, তৈরী হয়েছে চিনি কল ও সুতো কল। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। জলের হাহাকারে বহু অঞ্চলে (মারাঠাওয়া, বিদর্ভ এসব অঞ্চলে বিশেষ করে) চাষ বন্ধ হওয়া ও চাষির আত্মহত্যা একটা নিয়মিত বিষয়, আমরা সে কথা খবরে পড়ছি, দেখছি, রাজনৈতিক তর্জা ও শুনছি। একই ভাবে পাঞ্জাব, হরিয়ানা হয়ে উঠেছে ধান কেনার কেন্দ্র। ধান, যা বাংলাদেশ, ভারতের পশ্মিম বঙ্গ, আসাম, উত্তরপূর্ব ভারত, থাইল্যান্ড, চিন ও জাপানের জলসমৃদ্ধ অঞ্চলের ফসল তা গত ৫০ বছরে ওই সব অঞ্চলের প্রধান উৎপাদিত ফসল হয়ে গেছে (ধান খারিফে, গম রবিতে)। আর এসবই ১০০ শতাংশ উচ্চ ফলনশীল ধান, খারিফ মরশুমে চাষ হয়, যা ফ্রিতে পাওয়া বিদ্যুৎ, জল আর সরকারের মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসে এই সব রাজ্য থেকে ১০০ শতাংশ ধান কেনার সাথে লাফিয়ে বেড়েছে, আর তার সাথে বেড়েছে জলের অপচয়। বস্তুত অবস্থা এমন যে পাঞ্জাব, হরিয়ানার এগ্রিকালচার প্রডুইস মার্কেটিং কমিটি গুলি (এপি এম সি) তে উত্তর প্রদেশ, বিহার আর এই রাজ্য থেকে কম পয়সায় অভাবী ধান কিনে ফড়েরা সরকার কে বেশি দামে বেঁচে। পরিনাম হোল পাঞ্জাবের কৃষক যার গড় জমির পরিনাম মাথা পিছু ৩ হেক্টররেরও বেশি, তারা দেশের সবচেয়ে অর্থবান চাষি হলেও আজ ভুল কৃষি নীতির কারনে জল ও মাটির উৎপাদন সঙ্কটের মুখোমুখি হয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। “ওয়াটার প্রোডাক্টিভিটি অব ক্রপ” একটা নতুন পরিমাপ যা ফসল প্রতি কতটা জল সেচ দেওয়া হলো আর কতো ফসল উৎপাদন হলো তার হিসাব করে আর সেই হিসেব দেখাচ্ছে যে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা যেমন জমি পিছু ধানের উৎপাদনে সবার উপরে, তেমনি মিটার কিউব জল ব্যবহার হিসাবে এই রাজ্যগুলির উৎপাদন সবচেয়ে কম (০.২২কেজি/ ঘন মিটার, যদিও খরাক্রান্ত মহারাষ্ট্র, যেখানেও ধান চাষ হয়, সেখানে এইটা সবচাইতে কম ও ভয়াবহ চি্ত্র নিয়ে ০.১৭ কেজি/ ঘন মিটার)। একই রকম চিত্র আখের ক্ষেত্রে মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু ও কর্নাটকে দেখা যাচ্ছে, মানে ফসলের নির্বাচনটাই ভুল। আপাতত জল মিলে গেলেও সর্বনাশের বেশি বাকি নেই (নিচে ছবিতে ভারতের ধান চাষের জল চিত্র)।
কিন্তু এমন পরিস্থিতি খালি অপেক্ষাকৃত কম জলের রাজ্যগুলিতে নয়, জল সমৃদ্ধ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের বহু জেলায় ভূগর্ভস্থ জলের আধার শুকনো দিনে ১০০ ফুটের নীচে চলে যেতে শুরু করেছে (পাঞ্জাবে যা ৫০০ ফুট নীচে)। আসামে তো এমন হচ্ছে যে নিয়মিত বন্যা ও বন্যার জল সরে গেলে জলকষ্ট এক নিয়মিত বিষয়, বিশেষ করে দক্ষিণ ব্রহ্মপুত্রের জেলা গুলিতে। চাষের কাজে অতিরিক্ত জলের আহরণ আসামের এই সমস্ত অঞ্চলে ফ্লোরাইড দূষনের প্রাদূর্ভাব ছড়িয়ে দিয়েছে। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের ধান চাষ আর আর্সেনিক প্রাদুর্ভাব তো একদম পরস্পর সমানুপাতিক হারে বেড়েছে। মনে রাখতে হবে এই দুটি রাজ্যেই ধানের উৎপাদন শুধু হেক্টর প্রতি কমই নয়, প্রতি মিটার কিউব জল পিছুও উৎপাদন খুবই কম। তবে এ রাজ্যের ধানের উৎপাদন খারিফ মরশুমে মুলত বৃষ্টি নির্ভর হলেও বোরো চাষের নলকূপের জল তাকে ধনে না হলেও মানে পাঞ্জাবের সমতুল করেছে। এখানে বলে রাখা ভাল দেশের মোট ধান উৎপাদনে সবার উপরে পশ্চিমবঙ্গ আছে,যদিও জমির পরিমান পাঞ্জাবের দ্বিগুণ, এবং যেখানে মানুষ প্রধানত ভাত খায়। তবে এই রাজ্যের মোট উৎপাদিত চালের ১ শতাংশ ও কেন্দ্রিও মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসের কোন সাপোর্ট পায় না, আর তাই রাজ্যের গরীব কৃষক যার জমির পরিমান বাম আমলের অপারেশন বরগার কারনে পাঞ্জাব হরিয়ানার তুলনায় প্রায় কিছুই নয়, আর অধিকাংশই আবার ভাগচাষী, সে আরও গরীব হয়েছে।

পরিস্থিতি সত্যি জটীল। আন্তর্জাতিক সমস্ত সংস্থা ভারতের ভূগর্ভস্থ জলের উৎপাদনকে পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ বলছে এবং এটা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা যে শুধু মাত্র জলে সংকট ভারতের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সঙ্কট হিসাবে দেখা দিতে চলেছে।
এটা অস্বীকার করার আজ কোন জায়গাই নেই যে সবুজ বিপ্লব পরবর্তী সরকারি ভর্তুকি নির্ভর কেমিকাল চাষ, মাটি, ফসলের বিভিন্নতা, চাষ ও চাষির সর্বনাশ করেছে। এবং দেশের চাষ ব্যবস্থা শুধু চাল-গম ও এফ সি আই এর গুদাম নির্ভর হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। এফ সি আই এর গুদামে ১৬ বছরের পুরনো চালও রয়েছে আর এই পুরো ব্যবস্থাটাতেই সচ্ছতার অভাব রয়েছে। আর এফ সি আই ত সব রাজ্য থেকে কেনেও না। মুলত কেনে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা থেকে, বাকি রাজ্য, বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গের মতো রাজ্য, যে কিনা সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদন করে, এই বিষয়ে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। সচ্ছতার অভাব রয়েছে এম এস পি কি হবে তা নিয়েও (হওয়া উচিত C2+ 50%, মানে চাষের সব রকম খরচ, মায় জমির খরচ, সুদ, নিজের বা পারিবারিক শ্রম সব মিলিয়ে খরচের উপর ৫০ শতাংশ, কিন্তু সরকার জমির খরচ সব বাদ দিয়ে হিসাব করছে, আর এর পরেও অধিকাংশ জায়গায় এর বহু নিচে ফসল কেনা বেচা হচ্ছে)। নতুন কৃষি বিলগুলো এসব আলোচনা না করে, বরঞ্চ এর সুযোগ নিয়ে উলটে এম এস পি ও সরকারের ফসল কেনার ব্যবস্থাকেই তুলে দেওয়ার পথ সুগম করে তুলতে চাইছে। চাইছে পুরো ক্ষেত্রটা থেকে সরকারি দায় পুরো ঝেরে ফেলে এটিকে গুটি কয়েক অতিবৃহৎ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে। স্বাভাবিক ভাবেই দেশের কৃষকেরা বিশেষ করে পাঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকেরা ও ওই অঞ্চলের যাবতীয় বড়ছোট মাঝারি কৃষি উদ্যগিরা তাদের সর্বনাশের বার্তা পেয়ে এর বিরুদ্ধ যে বিপুল আন্দোলন সংগঠিত করেছেন সেটাই অভিপ্রেত। আপাতত এই আন্দোলনের পাশে অন্য রাজ্যের কৃষকেরাও এসে দাঁড়াচ্ছেন। কৃষকদের যাবতীয় দাবি গুলির প্রতি সম্পূর্ণ সমর্থন রেখেও এই কথাটাও বলা খুবই দরকার যে এটা হোল সেই অস্থির সময় যখন ফসলের দাম, ফসলের বিপনন, ফসলের মুক্ত মজুদ্দারির বিরোধিতা এসব নানান জরুরি বিষয়ের পিছনে লুকিয়ে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে এমন আরও দরকারি সেইসব বিষয় গুলি, যা এতো দিন ধরে পরিবেশ গবেষক ও বিজ্ঞানিরা বলে আসছেন। এখানে সেগুলই আলোচনা করবো।

কোন রাস্তা কি আছেঃপরিবেশগত অধিকাংশ সমস্যার কোন সমাধানের পথ আসলে প্রকৃত সমস্যাকে স্বীকার করা, সঠীক নীতি রূপায়ন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর দন্ডায়মান। আমরা যতই পরিকল্পনা করি না কেন এই তিনটি বিষয় না থাকলে (আর সেটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা) কোনভাবেই এই সমস্যার মোকাবিলা সম্ভব নয়। তবে সমস্যার ধরন ও স্থান অনুযায়ী এই সমাধান পথের কিছু প্রকারভেদ থাকবে, ইংরাজিতে আমরা যাকে Place based solution বলি। পরিবেশ গত অনেক সমস্যার মতো জল ও কৃষি উৎপাদন সংক্রান্ত সমস্যা গুলোর সমাধানে আমাদের বিজ্ঞানের সাথে সাথে সময়ের সাথে পিছিয়ে যেতে হবে, যেতে হবে প্রকৃতি কাছে, জানতে হবে কি ভাবে বহু শত বছর ধরে মানুষের সভ্যতা, বিশেষ করে উপজাতি ও মুল নিবাসি জন সম্প্রদায় বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের রত্ন সম বীজ ভান্ডার, তাদের দেশীয় কৃষি পদ্ধতি, যাকে বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন আই টি কে বা ইন্ডিজিনাস ট্র্যাডিশনাল নলেজ প্র্যাকটিস।
১) কোন সন্দেহ নেই যে গুজরাটের খরা অঞ্চলে তুলা,মহারাষ্ট্রের আখ ও পাঞ্জাবের ধান এর মডেল একটি ভুল কৃষি নীতির ফসল যা আমাদের দেশের জল সম্পদের সর্বনাশ করেছে। সমৃদ্ধ চাষিদের ভর্তুকি নির্ভর জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আমরা ভূগর্ভস্থ জলের মরুভূমি গড়েছি। প্রথম শর্ত হলো যে আখ ও তুলা চিনি কলে ও শিল্পে সাপ্লাই হয় তাতে সরকার দেশের মানুষের করের টাকায় ভর্তুকি দিতে পারে না। প্রান্তিক ও গরীব চাষিদের ক্ষেত্রে ভর্তুকি থাকতে পারে। একই ভাবে পাঞ্জাবের খারিফের ধান করতে লক্ষ লক্ষ নল কুপ তৈরির অনুমতি দিয়ে আমরা কি পাঞ্জাবের কৃষকদের ভাল করতে চাইছি?? প্রতি ঘন মিটার জলে কতো কেজি প্রোডাকশন হচ্ছে ও চাষিরা জমিতে জল ও মাটির উর্বরতা রক্ষার জন্য ঠিক কি কি পদক্ষেপ করছেন (এগুলো সহজে শেখানো যায় আর কৃষি আধিকারিকদের এটা বড় কাজ, আর কাজটা যে ঠিক মতো হয় না এটা এখন পরিস্কার হয়েছে) সেটা বাধ্যতামূলক করা দরকার। মানে একটা “ফার্ম ল্যান্ড সয়েল এন্ড ওয়াটার হেল্থ রিপোর্ট কার্ড” হবে। কৃষি সংক্রান্ত সব সুযোগ সুবিধা এর সাথে জোড়া থাকবে। সরকারের মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসের সুবিধা শুধু একটি দুটি রাজ্য নয় গোটা দেশ ও অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে হওয়া দরকার। সেটা বাড়লেই ফসলের বিভিন্নতা বাড়বে, আর এই বিভিন্নতা কৃষি বাস্তুতন্ত্র বা এগ্রো-ইকোলজির মাধ্যমে ঠিক করতে হবে অন্য কিছুর মাধ্যমে নয়।
২) একথা আজ নিশ্চিত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটিত সমস্যা থেকে আমাদের দেশের শুকনো জায়গাগুলোকে বাঁচাতে পারে মিলেট বা জোয়ার, বাজরা ও রাগি। ফুড সিকুরিটি বা খাদ্য নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমাদের ওই সব অঞ্চলের কৃষকদের দেশী প্রজাতির মিলেট চাষে ফেরাতেই হবে উপায় নেই। সরকার পাঞ্জাবের মতো রাজ্য গুলি থেকে জল খেকো ধান না কিনে মিলেট ও গম কিনুক, আর পশ্চিমবঙ্গ, আসামের মতো রাজ্য থেকে কিনুক ধান, এটাই উচিত হবে। এতেই ফসলের পরিবর্তন হবে ও কৃষকের রোজগার বাড়বে। গম লাগানোর জন্য মেসিনে কাটা উঠে যাওয়া ধানের গোঁড়া পোড়ানও বন্ধ হবে।
.৩) ফসল কেনার ও সরকারি সুবিধার ক্ষেত্রে দেশি বীজ ও জৈব পদ্ধতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এটাই তো আসল আন্দোলনের বিষয়। সরকার কেমিকাল চাষ ও উচ্চ ফলনশীল বীজের লবির জন্যে এই কাজটা সহজে করবে না। এই ব্যবস্থা্ গড়ে উঠলে, গড়ে উঠবে দেশীয় ফসলের বীজ ভান্ডার যা আমাদের বানিজ্যিক কৃষি ব্যবস্থার আক্রমন থেকে সুরক্ষা দেবে।
৪) বিটি কটন ও হাই ইয়েলডিং বীজ, সার, জল, কীটনাশকের মাত্রা বৃদ্ধি করে চাষির ও পরিবেশের সর্বনাশ করছে। এর সাথে লড়াই করার রাস্তা রেইন ফেড অরগানিক কটন, কমিউনিটি ভিত্তিক চরকায় সুতো কাটা ও খদ্দরের আন্দোলনে নতুন করে আস্থা রাখা দরকার, আর এই কাজে বিপুল গ্রামীণ কর্মসংস্থান হওয়া সম্ভব সেটা প্রমানিত। যেসব কৃষি সংগঠন ও কৃষকেরা আজকের এই কৃষি বিলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, তারা এই কাজটি করতে অস্বীকার করলে ভুল করবেন।
৪) কৃষি ক্ষেত্রে জল সংরক্ষণ এর একটা বড় উপায় ওয়াটার ব্যাঙ্কিং। এর মুখ্য বিষয় হলো অনেক গুলি কৃষি ক্ষেত্রের মধ্যে অপেক্ষাকৃত নিঁচু জায়গায় একটি জলের আধার তৈরী করা। এই জলাধারে পার্শ্ববর্তী সমস্ত কৃষিক্ষেত্র থেকে ও বৃষ্টির জল জমা হবে। শুখা মরশুমে চাষিরা এই জলাধার থেকে নিজের জমির মাপ অনুসারে জল পাবেন। আর সেই জল তাদের কাছে পৌছে যাবে সৌরচালিত মাইক্রো ইরিগেশন সিস্টেমের মাধ্যমে। এই সিস্টেম জমিতে অতিরিক্ত জল সরবরাহ না করে সরাসরি গাছের রুটে জল পৌছে দেয় ও ৭০ শতাংশ পর্যন্ত জল অপচয় বন্ধ করে। মোটকথা চাষের কাজে যেখানে সম্ভব বিন্দু সেচ ব্যবস্থা চালু করতেই হবে। এমনকি ধানের ক্ষেত্রেও নানান পদ্ধতি আবিস্কার হয়েছে যেখানে কম জলে ভাল ফসল হয়, যেমন SRI পদ্ধতি।

৫) চাষের জমি থেকে জল উবে যাওয়া আটকানো জল বাঁচানোর বড় ধাপ। মাটিতে খড় চাপান দেওয়া ও জমির উত্তর পশ্চিম দিক থেকে হাওয়া আসা আটকানোর জন্য গাছ বসানো বা এগ্রো ফরেস্ট্রি ভাল ফলদায়ী।
৬) আমরা নানাবিধ অরগানিক সার, কেঁচো সারের কথা বলি, এখন তো পালেকর সাহেব বেশ কিছু দিন ধরে জিরো বাজেট ফার্মিং এর কথা বলে জনপ্রিয় হয়েছেন (যদিও তিনি কম্পোস্ট ও কেঁচো সারকে অযৌক্তিক আক্রমন ও জিএম ফসলকে সমর্থন করেন এমনও শোনা যায়)। জলবায়ু পরিবর্তন ও গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর কথা মাথায় রেখে বিজ্ঞানীরা কৃষি জমির উর্বরতা, জল ধারন ক্ষমতা, বাতাস চলাচল এসব বাড়ানোর ক্ষেত্রে দুটি জিনিসের কোন জুড়ি নেই মনে করছেন। একটি হলো মুলত জাপানী কৃষি বিজ্ঞানী তেরিও হিগার আবিষ্কৃত জৈব পদার্থ কোহলিত করে তৈরী করা বোকাশি এবং আরেকটি হলো কৃষি জমি থেকে তৈরী হওয়া বর্জ্য থেকে প্রস্তুত এক প্রকার চারকোলের গুড়ো বা বায়োচার। এই দুটিই সহজেই কৃষকেরা নিজের জমিতে তৈরী করে নিতে পারেন। বছর বছর বর্জ্য না পুড়িয়ে, ও বায়ুদূষন না করে, এই দুটি যদি তারা করেন তবে সব দিক থেকেই লাভবান হবেন। তবে বায়োচার মুলত অম্লত্ব কমায় কাজেই ক্ষার জমিতে ব্যবহার করা যাবে না। মাটির ক্ষারত্ব কমাতে বোকাসি ও খড় চাপানের জুড়ি নেই। আরেকটি জিনিস খুবই ফলদায়ী আর সেটি হলো গোবর গ্যাসের স্লারি। এই রাজ্যে,সরকারি উদ্যোগে হুগলী জেলার বলাগড়ে চাষিরা গোবর গ্যাসের স্লারি মারফৎ ধান ও সবজি ফলিয়ে সাবলম্বি হয়েছে। ফার্মইয়ার্ড ম্যানিওর ও উপকারি জীবানু মিশ্রিত সার (জীবানু এখন চাষিরাও যাতে তৈরী করতে পারেন সে ব্যবস্থা করা যায়); গোবর, গোমূত্র, ব্যাসন, গুুড় জলে মিশিয়ে অল্প পঁচিয়ে তৈরী করা তরল সার, চাষি কে ইউরিয়া, ডি এ পি এর মরন আলিঙ্গন থেকে বাঁচাতে পারে। এতে মাটিতে উপকারি জীবানুর পরিমান বৃৃদ্ধি পেয়ে, মাটির গঠন, জৈবিক পদাার্থ, পি এইচ ও অনু খাদ্য সঠিক মানে থাকে আর ফসলের ফলন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বারে। একই ভাবে ভেষজ কীটনাষক, ছত্রাক নাষক, নানান ইন্টিগ্রেটেড পেষ্ট ম্যানেজমেন্ট যেমন আঁঁঠা ফাঁদ ও ফেরোমোন ট্র্যাপ চাষিকে ল্যাদা পোকা, জাব পোকা, দয় পোকা, শোষক পোকা, নালি পোকা, ফল ফুুঁটোকারী পোকা ও নানান ছত্রাকের হাত থেকে ফসলকে যেমন বাাঁচায় তেমন চাষের খরচ কমায়, খাদ্য ও পরিবেশকে বিষমুক্ত রাখে। এখন তো দেশিও প্রাকৃতিক ধান চাষে কোন রকম সার ছাড়া শুধু অ্যাজোলা দিয়ে চাষ করে উচ্চ ফলন প্রমান করে দেখানো হয়েছ। রাজ্য সরকারের এগ্রিকালচার ট্রেনিং সেন্টার, ফুুুলিয়া এ বিষয়ে ব্যপক কাজ করেছে, এখান থেকে এই রাজ্যর চাষিরা ৩০০ রকম দেশি ধানের বীজ পেতে পারেন।
৫) আমাদের দেশে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও জলবায়ু পরিবর্তনের সংগে তাল মেলাতে পারে এমন কোন ক্রপ অ্যাডভাইসারি সিস্টেম নেই। সেই এক মৌসম ভবন থেকে জারি হওয়া বর্ষার গতিপ্রকৃতি নির্ভর ও আঞ্চলিক কৃষি অধিকর্তার অফিস থেকে রেডিও ও টিভি মারফৎ প্রচারিত কৃষিকথার আসর। মেঘদুত বলে একটি কৃষি ভিত্তিক অ্যাপ কৃষি ও আবহাওয়া দপ্তর মিলে করেছে, তবে সমস্যা আছে আর খুব কম ব্যবহার হয়, কারন কেউ কৃষক কে এসব বলেই না। এর ফল কি হয়েছে আমরা জানি, পরিবেশ জনিত সমস্যা তো আছেই, কখনও খরা ও কখনও অতিবৃষ্টি কোন কিছুর সাথেই কৃষি উপদেশ খাপ না খাওয়ার ফলে, হয় কৃষক ভাল ভাবে চাষ করতেই পারছে না, নয়তো এতো উৎপাদন হচ্ছে যে দামও পাচ্ছে না। এর সমাধানে চাই এলাকা ভিত্তিক এমন এক ব্যবস্থা যা লোকেশন, লোকাল মাটির বৈশিষ্ট, আবহাওয়া, বাজার এসব বিচার করে ক্রপ ক্যালেন্ডার, ক্রপ সাজেশন, বেষ্ট প্র্যাকটিস সাজেশন দেবে। আজকের উন্নত স্যাটেলাইট পরিষেবা আর আই টির যুগে মোবাইল ফোনের উপর নির্ভর করে এই টেকনোলজি তৈরী করা এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়। চাইলে ওই ফোন গুলিও সরকার কৃষকদের কম পয়সায় বা ধারে দিতে পারে। এই ব্যবস্থা জল, পরিবেশ ও অর্থনীতি সবই রক্ষা করতে পারে।
৬) জলাভূমির ক্ষয় জল সংকট ও বন্যা এই উভয়েরই বড় কারন। জলাভূমি সংস্কার করে সেই জল ফিলট্রেশন সিস্টেমএর মধ্যে দিয়ে সাব সয়েলে পাঠিয়ে ভূগর্ভস্থ জলস্তর বৃদ্ধি করা সম্ভব, এই প্রক্রিয়াকে ম্যানেজড একুফায়ার রিচার্জিং বলা হয়। আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার বহু অংশে এটা করা হয়েছে ও তা খুবই সফল। কোন কারন নেই কেন এই প্রকল্প গুলি গ্রামীণ রোজগার পরিকল্পনায় এনে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করা যাবে না এ দেশে। এমন কি মহারাষ্ট্রে মতো রাজ্যেও এই কাজ কিছু হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে এই রাজ্যের জল ভর জল ধর প্রকল্পের দিশাও এইদিকে যাওয়া দরকার
৭) আমরা যদি জলাভূমিকে ব্যবহার করে প্রচুর নতুন বিকল্প কর্মসংস্থান এর পরিকল্পনা করি তাতে জলভূমিও রক্ষা পাবে ও মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নও হবে। স্বাভাবিক ভাবে জলাভূমি মাছ, মাখনা, সিঙ্গারা বা পানিফল, পদ্ম, হোগলা এসব এমনিতেই দেয়। বিজ্ঞানকে আরেকটু কাজে লাগিয়ে আমরা তৈরী করতে পারি ভাসমান সবজি বাগান যার তলায় থাকবে মাছের ঝোলানো খাঁচা (বা খাঁচা যেখানে করা যাবে না সেখানে জলাশয়েই বা পুকুরেই মাছ চাষ হবে)। নিচু জমির ক্ষেত্রে মাছ ও দেশি নিচু জমির ধান চাষ, পুকুরের আলে সবজি ও ফল চাষ ও পুকুরে মিশ্র পোনা মাছের চাষব্যবস্থা জলসম্পদে পরিপূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতির ভোল বদলে দিতে পারে।
৮) আমরা যদি এমন কোন সুস্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধি (আরটিফিটিয়াল ইন্টেলিজেন্স) চাষিকে মাটি, এলাকা, বাজার ফলনকারি আর পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে বলে দেবে সে কি ফলাবে, আর তার সাথে তৈরি থাকে এমন কৃষি সমবায়ের বা চাষিদের জোট যারা সরাসরি ক্রেতার কাছে নিয়ে আসবে ফসল, দেশে ও বিদেশে তবে চাষি অধিক মূল্য পাবেন।
পরিশেষেঃ উন্নয়ন তখনি সম্ভব যখন আমরা দুপায়ে হাঁটতে শিখবো। আর এই দুপায়ে হাঁটার বিদ্যা কিন্তু আমাদের দিয়ে গেছেন একজন গুজরাটি উকিল যার ১৫০ তম জন্মদিন আমরা সবে ঢাকঢোল বাজিয়ে পালন করে উঠেছি। অথচ যে অহিংস উন্নয়নের কথা বলে গিয়েছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যা ভারতে“গ্রাম স্বরাজ” আনবে তা নাথুরামের বুলেটে শুধুনয়, টাটা, বিড়লা, আম্বানি, আদানির মোটর, সিমেন্ট, সুতো, চিনিকল আর অধুনা এগ্রো মার্টের চকচকে উন্নয়ন ও মুনাফার সিন্দুকের তলায় চাপা পড়েছে বা যেতে চলেছে। ভারত, তার প্রকৃতি, জল, জমীন ও সাধারন মানুষকে বাঁচাতে গেলে সেই গ্রামস্বরাজের চরকা আমাদের কাটতে হবে। অন্য কোন বিকল্প নেই। আমরা বাঁচবো, বাঁচাবো নাকি বসে বসে ধ্বংস দেখবো ও মৃত্যুর দিন গুনবো তা শুধু এখন আমাদেরই হাতে।