ভারতবর্ষ যে আলাদা দূটো দেশ তা এর আগে কখনও এতো ভাল করে বোঝা যায় নি, যতটা কোভিড ১৯ মহামারী পরিস্কার করে দেখিয়ে দিলো। ভারত কতটা স্বাধীন, তার গনতন্ত্র আসলে কতটা শক্তিশালী নাকি ঠুনকো সেটাও এতটা প্রতীয়মান কোনদিন হয় নি। এই লেখা যখন লিখছি তখনও অসংখ্য কমিউনিটি কিচেন হাজার হাজার অসহায়, নিরন্ন মানুষকে কোন রকমে খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। কোটি কোটি মানুষের কাজ গেছে ও যেতে বসেছে, কৃষকেরা জানেনা তারা কি করে মাঠের ফসল বিক্রি করবে ও নতুন ফসল বুনবে। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক পথে কাজ হারিয়ে রাস্তায় কোনরকমে তৈরী করা অস্বাস্থ্যকর শিবিরে আধপেটা খেয়ে রাত কাটাচ্ছে, একটা ঘরে ফিরে যাওয়ার ট্রেনের আশায়। অথচ কেবেল টিভিতে এন্টারটেনমেন্টের বিরাম নেই। কারন আরেকটা ভারতের ঘরে বসে থাকতে থাকতে বোর লাগছে, তাই তাদের মন ভাল রাখা দরকার। মাঝে মাঝেই বড় বড় ডাক্তাররা আসছেন আর আশ্চর্য সব অঙ্ক ও রাশি বিজ্ঞানের আঁক কষছেন। বস্তুত ডাক্তাররা যে এতো অঙ্ক ও আঁক কষেন ও ভবিষ্যৎ বানী করে থাকেন সেটাও কোভিড মহামারী বোঝালো।
এমন পরিস্থিতিতে বাহ্যিক নয়, মনে হয় মস্তিষ্কেই লকডাউন হয়ে গেলো বুঝি আমাদের। তাও সামনের দিকে তাকিয়েই বাঁচা আর বা্ঁচানোর কথা ভাবতে হবে। গত কয়েকদিন সোশাল মিডিয়া ও অন্তর্জালে বহু মেঠো বন্ধুর সাথে কথা হয়েছে। একে মহামারী, লকডাউন, মানুষের হাতে কাজ নেই, টাকা নেই, বাজার কম, তার উপর শুরু হয়েছে অসময়ের বৃষ্টি। তাতে যা পরিস্থিতি সামনে এসেছে তাতে বলা যায় যে কোভিড মহামারী পরবর্তী অধ্যায়ে আমাদের কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতির অনেকটাই পরিবর্তন দরকার এটা বলাই বাহুল্য।
এমনই যখন অবস্থা তখন গত ৩০ এ এপ্রিল, ২০২০, জুমে একটা অসাধারণ টক শো নিয়ে হাজির হলেন ডঃ দেবল দেব। বালিগঞ্জ বিজ্ঞান কলেজের চিরকাল স্রোতের বিপরীতে হাঁটা দাদা। যিনি গত বিশ বছর ধরে মোটা মাইনের চাকরি, নিরাপদ জীবন, ঠান্ডা ঘরের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে শুধু প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পড়ে থেকেছেন আর এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৪০০ ফসলের রত্নসম মৌলিক বীজ সংরক্ষণ করেছেন, সংরক্ষণ করেছেন তার জিনগত তথ্যভান্ডার আর সেই বীজ, বীজ ও জীন লুন্ডনকারী বহুজাতিক বায়োটেকনোলজি কোম্পানির হাত থেকে বাঁচিয়ে, শত শত প্রান্তিক চাষির মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে তাদের করেছেন স্বনির্ভর। কোভিড মহামারী আক্রান্ত পৃথিবীর জন্য এক পরিস্কার অবশ্য পালনীয় কাজের কথা বলে গেলেন ডঃ দেব তার এই অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে, যা অনলাইন শোনার জন্য সেদিন সারা পৃথিবী থেকে হাউসফুল করে দর্শকেরা এসেছিলেন। তাই উদ্যোগতারা অনুষ্ঠান টি ফেসবুকেও লাইভ দেখার বন্দোবস্ত করেন ও আপলোড করেন। সবাইকে অনুষ্ঠানটি দেখার জন্য অনুরোধ রইলো। লিঙ্ক নীচে (একটু ধৈর্য্য ধরে শুনতে হবে, ট্রেলার শেষ হলে আসল অনুষ্ঠান শুরু হবে) https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=236951287526977&id=16433131359560
অনুষ্ঠান শেষ হলে আমি বসে বসে ভাবছিলাম, শুধু মাঠের ফসলের জৈব চাষ, মিশ্র ফসলের চাষ, বীজের অধিকার আর পারিবারিক চাষ, আর সরাসরি বিপনন এসব দিয়েও এই অসময়ের, অতিবৃষ্টির, ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক ও জলবায়ু বিপর্যয় গুলির সাথে লড়াই করা যাবে না। এই লড়াইকে সফল করতে গেলে এমন ব্যবস্থা চিন্তা করতে হবে যাতে ছোট ও প্রান্তিক চাষি, মাঠের ফসলের সাথে, মাছ, ভাসমান সবজি বা ফসল বাগান, আচ্ছাদিত অঞ্চলে সব্জি ও ফসল ফলাতে পারে (যেমন কম খরচের সোলার দ্বারা চালিত পলিহাউস)। একটা নষ্ট হলে যাতে আরেকটা বাঁচে। আমাদের চিন্তা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তন এর ঝুঁকি গুলো কি কি আর তার জন্য আমরা কি কি পরিবর্তন আনতে পারি।কিন্তু বলাটা যতো সহজ তত করাটা নয়। বিশেষ করে যারা মাঠে ময়দানে কাজ করছেন তাদের কাছে এটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। আরেকটা বড় বিষয় হলো স্থানীয় ভাবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস তৈরী করে চাষিকে দেওয়া। এসবের জন্য নানান ধরনের বিজ্ঞান কর্মী, কৃষি ও মৎস্য বিশেষজ্ঞ্য ও জৈব চাষিদের সমন্বয় চাই।
কোভিড পরবর্তী কালে অনেক বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে গরীব মানুষের হাতে টাকা চাই। কথাটা ঠিকই তবে এটা নিশ্চিত যে শুধু টাকা দিয়ে কোবিড পরবর্তী কালের অনিশ্চয়তাকে বিশেষ করে সেটা যদি জলবায়ু পরিবর্তন এর মতো ব্যাপক হয়, জয় করা যায় না। সাময়িক ভাবে হয়। চাষি অনেক জানে তাও অনেক কিছু জানার বাকী তার থাকেই, জানলে তারই উপকার।আমরা জানি চাষি জানে, আবার বিজ্ঞানীরাও জানে, শুধু তারা জানেনা তারা কি জানেনা। আর এটাই তারা পরস্পরের কাছ থেকে শিখতে পারে। এটাই দরকার। কারন অনেকদিনের কষ্টের ফসল একটা অসময়ের নিম্নচাপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পারে। একটা তৈরী ফসল লকডাউন এ মাঠ পঁচে যেতে পারে। তাহলে আমাদের সেফটি ভালব কি? আদও আছে কি?
ক্যারিবিয়ানের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তনী hurricane resistant farming model”এর কথা বলেছিলেন কিছুদিন আগে। এই মডেলে প্রচন্ড ঝড় ও বৃষ্টির সময় চাষের ক্ষেতগুলিকে লুকিয়ে ফেলা যায়, আবার ঝড় থামলে তারা বেড়িয়ে আসে। এই মডেলের অনেক কম খরচের ভারতীয়করন করা যায় কি? অথবা ইনডোর ভার্টিকাল বা স্ট্যাক ফার্মিং।কম খরচে বিদ্যুৎহীন গ্রামে ফ্রিজ ছাড়া কি করে বিক্রি না হওয়া ফসল সংরক্ষণ করবে গরীব চাষি? তেমনি আসামের মাজুলি দ্বীপে ভাসমান সবজি বাগান বন্যার সময় খুব ভাল ফল দিয়েছে। এটা বাংলাদেশের বিখ্যাত কচুরিপানার ভেলার চেয়ে আলাদা ও উন্নত। এইরকম মডেলের সাথে মাছের খাঁচা লাগানো যায় যেখানে জলের গভীরতা আছে, নইলে পেন খাটানো যায়।এমন বহু আলাদা আলাদা মডেল নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে। তবে মুল শর্ত খরচ কমানো ও এলাকা অনুযায়ী মডিফাই করা।
কোভিড পরবর্তী অধ্য্যায়ে এগুলিই আমাদের একটা বড় কাজ হওয়া দরকার। না প্রোজেক্ট প্রোপেসাল নয়। সে সব তো চলতেই থাকবে। নিজেদের করতে হবে। এবং এমন ভাবে করতে হবে সেই মডেলগুলি, যেনো সেগুলি আর্থিক লাভের মুখ দেখে, যাতে অনেক অনেক চাষি বন্ধু রা , অনেক কাজ হারানো মানুষ এসব দেখে উদ্ভূত হয়ে এগিয়ে আসতে পারে। আর এই ভাবেই শুরু হোক নতূন পৃথিবী গড়ার ভাবনা। হ্যা্ঁ বেঁচে থাকতে গেলে স্বপ্ন দেখতে হবে। আর সেটা বড় করে দেখাই ভালো।
সবাই ভাল থাকুন, সাবধানেও। লকডাউন শেষে নতুন স্বাভাবিক পৃথিবীতে দেখা হচ্ছে।