অমিতাভ আইচ
ওড়িষ্যার কেন্দ্রাপাড়া জেলায়, ব্রাহ্মণী আর বৈতরণী নদীর মোহনায় রয়েছে এক আশ্চর্য লবনাম্বু উদ্ভিদের অরন্যে, যা ছিল পূর্বতন কনিকা রাজবংশের জমিদারী এলাকা, কাঠ ব্যবসার ক্ষেত্র বা লগিং রিজার্ভ ও মৃগয়াক্ষেত্রও। গভীর, অগম্য, অপূর্ব ছিল ওই বনভূমি আর তাই তার নাম “ভিতরকনিকা”। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৬১ তে এটি একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল বা প্রোটেক্টড এরিয়া ঘোষিত হয়। অসাধারন জীববৈচিত্র্যর কারনে, অচীরেই, ১৯৭৫ সাল থেকে, ৬৭২ স্কোয়ার কিমি ব্যাপি এই লবনা্ম্বু উদ্ভিদ, সল্ট মার্স, নোনা জলের বিশালাকার কুমির, বিপুল পরিযায়ী, জলের ও মোহনার পাখিদের আবাসস্থল একটি অভয়ারন্য বা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি। ক্রমে ১৯৯৮ সালে এরই ১৪৫ কিমি কোর এলাকা নিয়ে গঠীত হয়, একটি জাতীয় উদ্যান বা ন্যাশানাল পার্ক আর ২০০২ সালে আসে আরেক বড় স্বীকৃতি, ভিতরকনিকা একটি আন্তর্জাতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি বা রামসার সাইট ঘোষিত হয়। অদূরেই রয়েছে গহিরমাথা সৈকত যা অলিভ রিডলে সামুদ্রিক কচ্ছপদের ডিম পাড়ার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঠিকানা, এখন একটি মেরিন স্যাংচুয়ারী। এই সমস্ত অঞ্চলের প্রায় ৩০০০ স্কোয়ার কিমি নিয়ে ঘোষিত হওয়ার কথা ভিতরকনিকা বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ, যা এখন মুলত ‘ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট ডিভিশন (ওয়াইল্ড লাইফ), রাজনগর, কেন্দ্রাপাড়া’র অধীনে, যার অধীনে রয়েছে পাঁচটি রেঞ্জ, কনিকা, রাজনগর, মাহাকালপড়া, কুজঙ্গ ও গহিরমাথা।
বাস্তুতান্ত্রিক দিক থেকে ভিতরকনিকা সুন্দরবনের পরেই ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরন্য হলেও, এর ম্যানগ্রোভের প্রজাতি বৈচিত্র্য সূচক বা স্পিসিস ডাইভারসিটি কিন্ত ভারতের সুন্দরবনের চেয়ে বেশী। এর একটা বড় কারন বৈতরনী, ব্রাহ্মণী ও ধামরা নদীর মিষ্টি জলের প্রবাহ, যা সুন্দরবনের ক্ষেত্র পূর্বদিকে প্রায় নেই বললেই চলে। ফলস্বরূপ সুন্দরবন থেকে অবলুপ্ত সুন্দরী আর গোলপাতার দেখা মিলবে এই অরন্যে। ভিতরকনিকায় সুন্দরীর তিনটি প্রজাতি পাওয়া গেছে যার একটিকে হেরিটিয়েরা কনিকেনসিস নামকরন করা হয়েছে (হেরিটিয়েরা বা Heritiera হলো সুন্দরির গন বা জেনাস নাম)। গর্জন, গরান, গেওয়া, বানী সহ রয়েছে প্রায় ৯৪ টি প্রজাতি যার মধ্যে রয়েছে প্রায় তিরিশ প্রকার প্রকৃত ম্যানগ্রোভ। আপনি যদি শুধু ডাঙ্গমাল দিয়েই বনদপ্তরের তৈরী করা ম্যানগ্রোভ ট্রেল বরাবর হাঁটতে থাকেন তবে আপনাকে অবাক করে দেবে বিশালাকার ও পুরুষ্ট পাতের মতো বাট্রেস রুট, যা মুলত জাইলোকারপাস গ্রানাটাম প্রজাতির বা ধুনধুল (ওড়িয়াতে সিসুমার) গাছের বৈশিষ্ট্য আর তারই সাথে সাথে চিতল হরিনের দলের নৈকট্য। আপনি আরও দেখতে পেতে পারেন গাছ থেকে শাঁসালো ডাব পেড়ে লাঞ্চ সারছে ম্যাকাক বাদরেরা। নদীর ভাটায় কাদার চড়ে দেখা যাবে ধানি ঘাস বা পোরটেরেসিয়ার ঘন সন্নিবেশ, অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে হেতালের বন, বন ঘেঁষে আরও উপরের দিকে অপেক্ষাকৃত শুকনো নোনা মাটিতে জন্মায় সোয়ডা গুল্ম যার টক পুরুষ্ট পাতা এলাকার মানুষের কাছে এক সুস্বাদু সব্জীও বটে। এক সময় এ জঙ্গলে প্রচুর চিতাবাঘ আর ঘড়িয়ালও ছিলো। এখন আর নেই।
কনিকা রাজারা আর তাদের অরন্য আইন বনাম স্বাধীন দেশের আইন:
কনিকা রাজপরিবারের নিজস্ব নথি থেকে পাওয়া তথ্য বলছে এই এলাকা তাদের শাসনে আসে ১২৮০ সাল থেকে, তারপর টানা ৫০০-৬০০ বছর ছিল তাদের একক অধীকার। পরে মোঘল, মারাঠা ও বৃটিশরা পরের পর রাজত্ব কালে এই এলাকার ইজারা কনিকা রাজবংশের হাতেই ছিলো, আর মুখ্যে শাসকেরা এরথেকে বাৎসরিক খাজানা পেতেন। তাই জঙ্গল, জঙ্গলের আশেপাশের মানুষ কি ভাবে জঙ্গলের অধিকার পাবেন, রাজারই বা জঙ্গল রেখে কি লাভ এসবই কনিকার ভঞ্জদেও রাজারাই ঠিক করতেন। বৃটিশরা প্রথমে ১৮৭৮ ও পরে ১৯২৭ এ যে ইন্ডিয়ান ফরেষ্ট অ্যাক্ট করে, তার মুল উদ্দেশ্য একই ভাবে জঙ্গলের বানিজ্যিক অধিকার নিজেদের হাতে রাখতে চাওয়া হলেও ক্রমাগত জঙ্গলের হ্রাস হওয়া কমানো আর কিছুটা বৈজ্ঞানিক বনরক্ষাও বটে। এই আইনের ফলে যেটা হয় নিজ নিজ অঞ্চলে রাজারাও এই বন আইনের সুবিধা নিয়ে নানা নতুন নিয়মাবলি তৈরী করেন। ভিতরকনিকা যা স্বাধীন ভারতের বন্যপ্রাণী আইন ও ন্যাশানাল পার্ক ঘোষিত হবার পর সাধারন বনের আশেপাশের মানুষের কাছে এখন সম্পূর্ন অগম্য তা কিন্তু বরাবর তা ছিলো না। কনিকা রাজাদের আমলে চালু ছিল এক অতি উন্নত বন আইন, যাতে গোটা জঙ্গলকে নানা ভাগ করে সংরক্ষণ ও ব্যবহার করা হতো যাতে ছিল আটক্ জঙ্গল (যে খানে কেউ প্রবেশ করতে পারে না, বন্য প্রাণী ধরতে, মারতে বা গাছ কাটতে পারে না), রক্ষিত জঙ্গল (যেখানে চক্রাকার আকারে বনসম্পদ আহরন ও সংরক্ষণ পালন করা হয়) আর চাদ্দা জঙ্গল (যেখানে পয়সার বিনিময়ে গ্রামের মানুষের নির্দিষ্ট নীতি মেনে জমির পাট্টা পেতো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য)।
স্বাধীনতার আগে আগে, কনিকার রাজারা জঙ্গলের একেক অংশ মূলত জমি হারানোর ভয় থেকেই ইজারা দিতে থাকেন। স্বাধীনতার পরেই রাজা পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে লোক পাঠান, এখবর ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যে রাজা এক একর করে জমি ৫ টাকায় বিক্রি করবেন, শুধু জঙ্গল কেটে নিজেরাই বসবাসের ও চাষবাসের উপযুক্ত করে নিতে হবে। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পরে ও এ রাজ্য থেকে শয়ে শয়ে লোক ভিতরকনিকায় চলে আসতে শুরু করে। আর এটাই ভিতরকনিকায় বিপুল বাঙ্গালি পরিবারের বসবাসের মুল কারন।
ওড়িষ্যায় জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত (১৯৫১) স্বাধীন ভারতের ওড়িষ্যা রাজ্যে ভিতরকনিকা, কনিকা রাজ বংশের হাতেই ছিলো, পরে রেভিনিউ দপ্তরে ও ১৯৫৭ সালের শেষ থেকে বনদপ্তর দায়িত্ব নেয় ও ১৯৭৫ সালে অভয়ারন্য ঘোষিত হওয়ার আগে পর্যন্ত গ্রামবাসীরা পূর্বতন কনিকা রাজত্বের নিয়ম মেনেই পাট্টা পেতো, পেতো মরা, পড়া ও শুকনো গাছ, ফল, পাতা, ঘাস, মধু, মোম, শামুক ঝিনুকের খোল, মাছ, কাঁকড়ার অধিকার। তবে প্রথমে স্যাংচুয়ারি ও পরে ন্যাশানাল পার্ক এই মানুষ ও প্রকৃতির মেল বন্ধনে বেঁচে থাকা ও গড়ে ওঠা নিবিড় মায়বী অরন্য উপর লোহার সাটার নামিয়ে দেয়। যার ফলে জঙ্গলের আশেপাশের মানুষের অরন্তার ন্যুনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় কারন রাষ্ট্র মনে করে যে মানুষকে জঙ্গলে ঢুকতে দিলে সে জঙ্গলের বিনাশ ঘটাবে। অথচ তথ্য বলছে, যে হেতাল গাছ একসময় এই অঞ্চলে ব্যপক ছিলো তা আজ বিলুপ্তির পথে কারন হেতালের পাতা যা ঘর ছাওয়া, দড়ি তৈরী এসবে ব্যবহার হতো, হেতাল ফল খাওয়া হতো ও এসব ব্যবহারের ফলে ক্রমাগত গাছ গুলি ছেটে নতুন গাছ গজানোর সাহায্যকারী প্রক্রিয়াটাই এর ফলে বিনষ্ট হয়ে গেছে। আর অরন্যে অধিকার বঞ্চিত মানুষ লেগে পরেছে নতুন ধ্বংস লিলায়, গ্রামের আশেপাশে নদীর ধারে যেটুকু ম্যানগ্রোভ আছে তাকে ধ্বংস করে ও চাষের জমিকে চিংড়ি চাষে লাগিয়ে।
আর এভাবেই হাজার বছরের প্রাচীন এক ভূমি আর তার আশ্চর্য প্রকৃতি এক নতুন বিপর্যয় এর মুখোমুখি, আর সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় সে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে স্বাধীন দেশ এবং পরাধীন দেশে যার চিহ্নও ছিলো না।
কৃতজ্ঞতা স্বিকারঃ সাউথ এশিয়ান ফোরাম ফর এনভাইরন্মেট
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত